একযুগেরও বেশি সময় বন্ধ ছিলো কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল সেকশনের ‘লাতুর ট্রেন’। লাতুর লাইনে ট্রেনের হর্ন আবার বাজবে। দ্রুত গতিতে চলছে রেললাইনের সংস্কার কাজ। এতে সিলেটের বিয়ানীবাজার ও মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, জুরী ও বড়লেখা উপজেলার ৭ লক্ষাধিক মানুষের মাঝে আনন্দের উচ্ছাস বইছে।

৬৭৮ কোটি টাকার সংস্কার প্রকল্পের আওতায় রেলের পুরাতন ব্রিজ ও স্টেশন ঘর ভাঙা এবং রেল লাইনের পাটাতন ওঠানোর শুরু হয়েছে। বড়লেখা উপজেলার সীমান্ত এলাকা কুমারশাইল গ্রাম থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রেললাইন পুনঃস্থাপনের এ কাজ শুরু হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে বড়লেখার উত্তর শাহবাজপুর ও দক্ষিণভাগ এলাকায় দুটি ইয়ার্ড তৈরিসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৫ সালে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অংশ হিসেবে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন চালু হয়েছিল। বড়লেখা উপজেলার লাতু সীমান্ত দিয়ে কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন হয়ে আসাম রেলওয়ের ট্রেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আসা যাওয়া করত। কুলাউড়া-শাহবাজপুর লাইনে চলাচলকারী ট্রেনটি এলাকাবাসীর কাছে ‘লাতুর ট্রেন’ নামে পরিচিত ছিল। জুড়ী, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলী, বড়লেখা, মুড়াউল, শাহবাজপুর পাঁচটি স্টেশন এ লাইনে রয়েছে।

চলাচলের অনুপোযোগী হয়ে পড়া রেললাইনটি সংস্কার করার বদলে তা ২০০২ সালের ৭ জুলাই বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ । রেললাইনটি আবার চালুর জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন এলাকাবাসী। অবশেষে পরিত্যক্ত রেললাইনটি সংস্কারের কাজ পুরোদমে শুরু হওয়ায় কুলাউড়া, বড়লেখা, জুড়ী ও বিয়ানীবাজার উপজেলার জনসাধারণের মধ্যে দেখা দিয়েছে উৎসবের আমেজ।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া সেকশনের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী (কার্য) মো. জুয়েল হোসেন সংস্কার কাজের বিষয়ে জানান, ‘এতো দিন কাজ দৃশ্যমান ছিল না। এখন কাজ দৃশ্যমান হচ্ছে। ব্রিজ ভাঙা ও পুরাতন রেললাইন ওঠানোর কাজও চলছে। কাজের জন্য সব যন্ত্রপাতি স্পটে রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেছে।’

দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলায় এলাকাবাসীর সন্তোষের বিষয়ে বড়লেখা উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সেলিম আহমদ খান জানিয়েছেন, ‘রেলের কাজ শুরু হওয়ায় মানুষের মাঝে আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। লাইনটি চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষজন কম খরচে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত করতে পারবে।’

কুলাউড়া শাহবাজপুর (লাতুর) লাইনে একাধিকবার ট্রেন লাইনচ্যুত ও লাইন সংস্কার না হওয়ার কারণে ২০০২ সালের ৭ই জুলাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো ঘোষণা ছাড়াই ট্রেন বন্ধ করেন। ট্রেন বন্ধ হওয়ার পর থেকে রেলের সম্পদ লুটপাট ছাড়াও দখল করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার ভূমি।

বৃটিশ শাসনামলে নির্মিত আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের এ পথটি ছিল আসাম-চাঁদপুর, আসাম-সিলেট যোগাযোগ রক্ষাকারী গুরুত্বপূর্ণ রেল রুট। তখনকার সময়ে রেল লাইনটির নাম ছিল কুলাউড়া-লাতুর লাইন। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর এ লাইনের নাম পরিবর্তন করে কুলাউড়া-শাহবাজপুর নামকরণ করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধ হওয়ার ফলে রুটটি হয়ে পড়ে অবহেলিত। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইনে ট্রেন চলাচলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। ফলে ঘন ঘন দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে।

১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের সময় রেলওয়ে প্রকৌশলীরা লাইনটি পরীক্ষা করে রেল চলাচল অযোগ্য ঘোষণা করে রেলের গতি সীমা ১২-২০ কিমি. বেঁধে দেন। কর্তৃপক্ষ জুড়ী কন্টিনালা নদীর ওপর ২৩৩নং ব্রিজটি ডেড স্পট বলে রিপোর্ট দিলেও প্রতি সপ্তাহে ২-১ বার দুর্ঘটনা কবলিত হতে থাকে ট্রেন। ঘন ঘন দুর্ঘটনার অজুহাতে কর্তৃপক্ষ রেললাইনের সংস্কার না করে অঘোষিত ভাবে ২০০২ সালের ৭ই জুলাই ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন।

কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল রুটের সংস্কার করে রেল পুনরায় চলাচলের দাবিতে জুড়ী, বড়লেখা ও বিয়ানীবাজার এ তিন উপজেলার মানুষ আন্দোলন শুরু করে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ আলহাজ শাহাব উদ্দিনের নির্বাচনী প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল ট্রেন পুনরায় চালুর। তিনি বার বার সংসদে এ ব্যাপারে কথা বলেন। সর্বশেষ হুইপ আলহাজ শাহাব উদ্দিনের আন্তরিকতায় ৯ই নভেম্বর ২০১৩ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বড়লেখা সফরে নিয়ে আসেন। ডিগ্রি কলেজ মাঠে বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী পুনরায় ট্রেন চালুর ঘোষণা দেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ২৬ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৬৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ পুনঃস্থাপন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ভারত সরকার ৫৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ৪৪ দশমিক ৭৭ কিলোমিটারের পুরোটাই ডাবল গেজ লাইন করা হবে। এর মধ্যে সাত দশমিক ৭৭ কিলোমিটার লুপ লাইনের কাজ হবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদির বাংলাদেশ সফরকালে অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে এ প্রকল্পটিও উদ্বোধন করেন।